বাঙালি জাতির সংস্কৃতিতে খাওয়া দাওয়ার বিষয়টি একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে।কেননা বাঙালি বরাবরই ভোজন প্রিয় জাতি হিসেবে পরিচিত । বাংলাদেশের প্রতিটা জেলারই রয়েছে আলাদা আলাদা খাদ্যাভ্যাস। একেক অঞ্চলের মানুষের রান্নার পদ্ধতি একেক রকম এবং খাবারের স্বাদও হয় অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। দেখা যায় একই খাবার সব জেলাতেই তৈরি হলেও কোনো বিশেষ এক ধরনের খাবারের জন্য শুধুমাত্র বিশেষ একটি অঞ্চলই বিখ্যাত হিসেবে বিবেচিত।বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস তাই খুবই বৈচিত্র্য ময়।
আজকে পরিচিত হবো বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিখ্যাত সব খাবার ও খাবারের পরিচিতি নিয়ে।ময়মনসিংহ জেলায় এমন কিছু খাবার আঞ্চলিক ভাবে তৈরি হয় যেসব খাবারের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ পরিচিত নয় বললেই চলে।তো চলুন জেনে নেয়া যাক ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার সম্পর্কে।
১. মুক্তাগাছার মণ্ডা
বাংলাদেশের বিখ্যাত একটি মিষ্টান্নর নাম হলো মুক্তাগাছার মন্ডা।এই মিষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে আছে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার নাম।একজন্যই এই মিষ্টির নামকরণ করা হয়েছে মুক্তাগাছার মন্ডা।ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে,১৮২৪ সালে রাম গোপাল পাল সর্বপ্রথম এই মিষ্টি তৈরি করেছিলেন। এই মিষ্টি শুধুমাত্র ময়মনসিংহেই পাওয়া যায়।তাই অন্য অঞ্চলের যে কেউ চাইলেই এই মিষ্টির স্বাদ,গন্ধ ও উপাদান ঠিক রেখে এই মিষ্টি তৈরি করতে পারবে না।এটা মিষ্টি তৈরির প্রনালী এখনও পর্যন্ত এই অঞ্চলের ময়রা ছাড়া কেউ জানতে পারেনি।এই মিষ্টির মূল উপাদান ছানা,চিনি ও গুড়।
২. জাকির মিয়ার টক মিষ্টি জিলাপি
ময়মনসিংহ জেলার আরেকটি বিখ্যাত খাবার হলো জাকির মিয়ার টক মিষ্টি জিলাপি।সাধারণস জিলাপি মিষ্টি হলেও, এই জিলাপির বিশেষত্ব হচ্ছে এটা টক মিষ্টি স্বাদের কম্বিনেশনে তৈরি।জানা গেছে প্রায় দুই যুগ ধরে তৈরি হচ্ছে বিখ্যাত এই টক মিষ্টি জিলাপি।রমজান মাসে সব ধরনের ইফতারি আইটেমের পাশাপাশি নগরীর জিলা স্কুলের মোরে ক্রেতাদের লম্বা লাইন পড়ে শুধুমাত্র এই টক মিষ্টি জিলাপি কেনার জন্য।
সাধারণত জিলাপি তৈরি করতে আটা ময়দা ব্যবহার করা হলেও, বিখ্যাত এই এক মিষ্টি জিলাপি তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয় চালের গুড়ো, মাষকলাইয়ের ডাল এবং ময়দা।সারারাত সবগুলো উপাদান মিশিয়ে গোলা তৈরি করে রেখে সকাল বেলা ভাজা হয় এই জিলাপি।
৩. ম্যারা পিঠা
ময়মনসিংহ জেলার সবথেকে বিখ্যাত পিঠা হলো ম্যারা পিঠা।শীতকালে এই অঞ্চলের প্রতিটা ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় ম্যারা পিঠা।সামান্য কিছু উপকরণ লাগে এবং বানানো ও বেশ সহজ বলেই এই পিঠা বেশ জনপ্রিয় এই অঞ্চলে।
চালের গুড়ো পরিমান মতো লবন দিয়ে সিদ্ধ করে রুটির কাই তৈরি করে নিতে হয় প্রথমে । তারপর সেই কাই নিয়ে ছোট ছোট বলের মতো তৈরি করে নিতে হয়।তারপর সেই বলগুলোকে ইচ্ছে মতো লম্বাটে,কিছুটা চ্যাপ্টা বা কোনক আকারের সাইজ করে নিয়ে ভাপে সিদ্ধ করা হয়।সিদ্ধ করা এই পিঠা বেশি করে ঝাল দিয়ে বানানো শুটকি ভর্তা দিয়ে গরম গরম পরিবেশন করা হয়।শীতের সকালে রোদে বসে গরম গরম ম্যারা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা।
৪. মিডুড়ী
ময়মনসিংহের খাবারের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই “মিডুড়ী”। মিডুড়ী হচ্ছে মিষ্টি জাতীয় একধরনের খাবার।আগে ময়মনসিংহের প্রতিটি বিয়ে বাড়িতে,মিলাদে বা যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ডেজার্ট আইটেম হিসেবে থাকতো এই মিডুড়ী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এখন মিডুড়ী খাওয়ার প্রচলন অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।বর্তমানে ফিরনি বা পায়েস এই মিডুড়ীর যায়গা দখল করে নিয়েছে।
দুধ,পোলাওয়ের চাল,সাবুদানা, নারকেল,বাতাসা ও খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি করা হয় মিডুড়ী। আগের রাতে চাল ও সাবুদানা ভিজিয়ে রেখে নরম করে নিতে হয়।তারপর ভালোভাবে এগুলো চটকে নিতে হয়।বাতাসাগুলো হালকা গুড়ো করে নিতে হয়।তারপর দুধ,বাতাসা গুড়ো,চটকে নেয়া চাল ও সাবুদানা, নারকেল, খেজুরের গুড় একসাথে জ্বাল করে তৈরি করা হয় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ” মিডুড়ী “।
৫. কবাক
ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় খাবার হলো “কবাক”।এটা শুধুমাত্র ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষই খেয়ে থাকে।ময়মনসিংহের বাইরে এই খাবার রেসিপি বা খাওয়ার পদ্ধতি কেউ জানে না বললেই চলে।কিন্তু এই খাবারের স্বাদ এতোটাই বেশি যে একে রাজকীয় স্বাদের খাবার বলা হয়।
কবাক তৈরি করা হয় দেশী মোরগ দিয়ে।দেশী মোড়গের চামরা ও পশম ভালোভাবে পরিষ্কার করে মসলা মেখে শিকে ভারে পুড়তে দেয়া হয় উঠোনের চুলায়।তারপর সেই মোড়গ ও বেশিকরে পেয়াজ মসলা নিয়ে যাওয়া হয় ঢেকিতে কুটতে। কোটা শেষ হলে সরিষার তেল মেখে গরম গরম ভাত অথবা পিঠার সাথে পরিবেশন করা হয় ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় স্বাদের খাবার ” কবাক”।
৬. গরুর মাংসের শুটকি
গরুর মাংস তো আমরা সবাই ই খুব পছন্দ করি।আর এই গরুর মাংসের জন্য আছে নানা ধরনের রেসিপি।কিন্তু গুরুর মাংসের শুটকির কথা কি শুনেছেন কখনও?
অনেকেই হয়তো ভাববেন গরুর মাংসের আবার শুটকি হয় নাকি?
হ্যাঁ, হয়।আর এই গরুর মাংসের শুটকি ময়মনসিংহের স্থানীয় লোকজনের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবার।বিশেষ করে কুরবানির সময় দেখা যায় ময়মনসিংহের বেশিরভাগ বারিতেই গরুর মাংসের শুটকি তৈরি করার জন্য শুকোতে দেয়া হয়েছে।
গরুর মাংসের সাথে হলুদ ও লবন মেখে সেগুলো লোহার তারের মধ্যে ভরে রোদে শুকানো হয়।পুরোপুরি রোদে শুকানো হয়ে গেলে বয়াম ভরে সারাবছর সংরক্ষণ করে খাওয়া যায় এই গরুর মাংসের শুটকি।
কেউ ভর্তা করে খায়, কেউ আবার সারারাত ভিজিয়ে রেখে নরম করে সাধারণ মাংসের মতোই রান্না করে খায়।সারা বছর গরুর মাংস সংরক্ষণ করে রাখার জন্য এটা কিন্তু দারুণ একটি পদ্ধতি হলো এই শুটকি।
৭. চ্যাপা শুঁটকি
ময়মনসিংহের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় শুটকি একটি প্রিয় খাবার।তারা যে কোনো ধরনের রান্নতেই শুটকি ব্যবহার করে। শুঁটকির মধ্যে পছন্দের সেরা তালিয়ায় রয়েছে চ্যাপা শুটকি। চ্যাপা শুটকি তারা প্রায় সব ধরনের তরকারির মধ্যেই ব্যবহার করে থাকেন।বর্তমান বাজারে চ্যাপার মূল্যও যেমন বেশি চাহিদাও প্রচুর।এখন শুধু ময়মনসিংহ নয়, সারা বাংলাদেশেই চ্যাপা শুটকি একটি জনপ্রিয় খাদ্য।
কাচা পুঁটি মাছকে মাটির হাড়িতে রেখে বিশেষ এক পদ্ধতিতে বেশ কয়েকদিন সময় নিয়ে তৈরি করা হয় এই শুটকি।শুটকি প্রেমিকদের কাছে চ্যাপা শুঁটকির ঘ্রান মাংসের ঘ্রানকেও হার মানায়।
বিভিন্ন ভাবে রান্না করা যায় এই চ্যাপা শুটকি। যেমনঃ চ্যাপা ভর্তা,পেয়াজ দিয়ে ভুনা,যে কোনো ভাজিতে চ্যাপা শুটকি,খুদে ভাতের সাথে চ্যাপা,বেগুন আলু দিয়ে চ্যাপা,চ্যাপা পিঠা আরও কতো ভাবে যে খাওয়া যায় এই শুটকি তার কোনো হিসেব নেই।
৮. খুদের ভাত
ধান থেকে চার ছাড়ানোর সময় কিছু কিছু চাল ভেঙে ছোট ছেট টুকরো বা কনায় পরিনত হয়।এই ছোট ছোট কনাগুলো বা চালের টুকরো গুলোই হলে খুদ।খুদ দিয়ে বিশেষ একধরনের খাবার রান্না করা হয়, যাকে বলে “খুদের ভাত”।
রান্না করার স্টাইল ও স্বাদ উভয়ই পোলাওয়ের মতো।ময়মনসিংহের মানুষের খুবই প্রিয় একটি খাবার এই খুদের ভাত। পেয়াজ, মরিচ ও রসুন ভালোভাবে ভেজে,ধুয়ে রাখা খুদ দিয়ে দিতে হয় তার মধ্যে। এরপর পরিমান মতো পানি দিয়ে পোলাওয়ের মতো ঝরঝরে করে রান্না করা হয় খুদের ভাত।
কেউ কেউ সাথে অল্প ডালও ব্যবহার করে।কিন্তু হলুদ ব্যবহার করা যাবে না।গরম গরম খুদের ভাত পরিবেশেন করা হয় হরেক রকম ভর্তার সাথে।শুটকি ভর্তা,মরিচ ভর্তা,ধনেপাতা ভর্তা,আলু ভর্তা, কালোজিরে ভর্তা এছারাও যে কোনো ধরনের ভর্তার সাথে খাওয়া হয় ঐতিহ্যবাহী এই খুদের ভাত।
ঐতিহ্যে ভরপুর বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতি।কিন্তু আধুনিকতার ছোয়ায় হাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের মূল্যবান সম্পদ এই ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার।সেই সাথে সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে বাঙালির সংস্কৃতিও।তাই আসুন সবাই মিলে নিজেদের দেশের সম্পদ ও মূল্যবান সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে দেশীয় খাবারের মুখাপেক্ষী হই।

