খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত কুমিল্লা জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রাচীন জনপদ । এই জেলার সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলার ইতিহাস , ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি । কুমিল্লার বিখ্যাত খাবারের কথা বললেই প্রথমে চলে আসে রসমালাই এর নাম । শুধু রসমালাই ই নয় , এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বেশ সমৃদ্ধ করেছে এখানকার নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় খাবার । কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় সব আঞ্চলিক খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে আজকের এই আয়োজন ।
১. কুমিল্লার রসমালাই
সেরা মানের উৎকৃষ্ট স্বাদের রসমালাই মানেই কুমিল্লার রসমালাই । কুমিল্লার সব জায়গার রসমালাই যে আবার সেরা তা কিন্তু নয়। একমাত্র কুমিল্লার মাতৃ ভান্ডার এর রসমালাই-এ ই অথেনটিক ঐতিহ্যবাহী স্বাদ পাওয়া যায় ।কুমিল্লা নগরের মনোহরপুরে অবস্থিত বিখ্যাত এই মাতৃ ভান্ডার ।
১৯৩০ সালে কুমিল্লার মাতৃ ভাণ্ডার রসমালাই প্রথম রসমালাই বানিয়ে নিজেদের সুনাম কুড়োয়। তখন থেকে নিজস্ব অথেনটিক স্বাদের গুন ধরে রাখছে এই দোকানটি। তবে আনুমানিক ১৯০০ সালের দিকেই কুমিল্লা অঞ্চলে রসমালাই তৈরি শুরু হয়েছিল।
কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ধরে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন হয়ে আসলে তা দিয়ে ছানা তৈরি করা হয় । এরপর ছানা কেটে ছোট ছোট মিষ্টি তৈরি করা হয় । পরে রসের মধ্যে দিয়ে বানানো হয় অপূর্ব স্বাদের রসমালাই।
কুমিল্লায় বেড়াতে গেলে মাতৃ ভান্ডার এর রসমালাই চেখে আসে না, এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়।
২. কাঁচা মরিচের রসগোল্লা
মিষ্টি তো মিষ্টিই হবে, তা আবার ঝাল কি করে হয়?
হ্যাঁ, আলাদা এক স্বাদের মিষ্টি ‘কাঁচা মরিচের রসগোল্লা ‘। মিষ্টি স্বাদের উপরে ব্যবহার করা হয় কাঁচামরিচের ঝাল, ফলে এর স্বাদ হয় ঝাল মিষ্টি । সম্প্রতি কুমিল্লা জেলায় খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই কাঁচামরিচের রসগোল্লা ।
বিখ্যাত ও আলাদা স্বাদের কাঁচামরিচের মিষ্টি উদ্ভাবন করেছেন কুমিল্লার টমছম ব্রিজ রেলিশ বেকারি এন্ড কনফেকশনারির মালিক মাসুদ খন্দকার। প্রথমে পরীক্ষামূলক ভাবে ১৫ কেজি ছানার মিষ্টি বানানো হয়েছিল। পরে এই ভিন্ন স্বাদের মিষ্টির কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার ফলে প্রচুর ভিড় জমতে থাকে এই মিষ্টির দোকানে। এভাবেই জনপ্রিয়তা পায় ঝাল মিষ্টি স্বাদের কম্বিনেশনে তৈরি ‘কাঁচামরিচের রসগোল্লা ‘।
দুধ জ্বাল করে ছানা তৈরি করে সেই ছানা মাখানোর সময় তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয় একদম মিহি করে পেস্ট করা কাঁচামরিচ । তাই দিয়ে বানানো হয় গোলাকৃতির মিষ্টি । পাতলা করে তৈরি করা চিনির সিরায় সবুজ রঙের মিষ্টি দিয়ে জ্বাল করে নেয়ার সময় তার মধ্যে দেয়া হয় দু ভাগ করা কাঁচামরিচের টুকরো। এভাবেই ছানা, চিনি ও কাঁচামরিচের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় অনন্য স্বাদের ‘কাঁচামরিচের রসগোল্লা ‘।
৩. পেড়া মিষ্টি
কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই এর মতো আরও একটি জনপ্রিয় মিষ্টান্ন পেড়া মিষ্টি । কুমিল্লা যাবেন আর পেড়া মিষ্টির স্বাদ নিয়ে আসবেন না এ আবার কখনও হয় নাকি। প্রতিটি কামড়ে কামড়ে পাওয়া যায় মধুময় স্বাদ ও অনন্য সুন্দর সুঘ্রাণ । রাজকীয় স্বাদের কারনে বাংলাদেশ সহ বিদেশেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে কুমিল্লার বিখ্যাত পেড়াবমিষ্টি । বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অনলাইন ব্যবসায়ীদের হাত ধরে অনলাইন মাধ্যমে এই মিষ্টির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায় ।
পেড়া মিষ্টির মূল উপকরণ দুধ। গুড়া দুধ ও কনডেস্ট মিল্ক একসাথে জ্বাল করে একদম শক্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। সাথে দিয়ে দেয়া হয় জাফরান ও এলাচ গুঁড়ো। শক্ত ডো তৈরি করে হাতে ঘি মেখে গোল ও কিছুটা চ্যাপ্টা আকৃতির মিষ্টি তৈরি করে নেয়া হয়। মাঝখানে চাপ দিয়ে কিছুটা গর্ত করে তার মধ্যে দিয়ে দেয়া হয় পেস্তা বাদাম কুচি।
পুরো প্রসেসিংটা দুধ দিয়ে করা হয় বলে খেতে হয় অসাধারণ ।
৪. কচুর মুখির ডাল
কুমিল্লার মানুষের খুবই প্রিয় একটি খাবার কচুর মুখির ডাল । নাম ডাল হলেও, এই খাবার রান্না কোনো ধরনের ডাল ব্যবহার করা হয় না। ডালের মতো পাতলা করে কচুর মুখি রান্না করা হয়। কচুর মুখির ডাল হলে আপনি অন্য কোনো তরকারির কথা হয়তো ভুলেই যাবেন।
ছোট ছোট কচুর মুখি যা বিভিন্ন অঞ্চলে কচুর গাডি নামেও পরিচিত – এই কচুর মুখি সিদ্ধ করে চটকে পানির সাথে গুলে নিতে হয়। সব ধরনের মসলা দিয়ে রান্না করা হয় পাতলা ডালের মতো, চাইলে কেউ সাথে ভাজা মাছও দেয়। শেষ সময় পেয়াজ রসুন এর ফোঁড়ন দিয়ে নামিয়ে ফেলা হয় মজাদার কচুর মুখির ডাল।
কুমিল্লার সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় বেশ পছন্দের খাবার এই ডাল।
৫. হাসনের দলা
কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষের খুবই প্রিয় একটি মুখরোচক খাবার ‘হাসনের দলা’ যাকে অনেক হাসন বলেও চেনে। হাসনের দলা মূলত এক ধরনের নাড়ু জাতীয় খাবার। নাড়ু আমরা কম বেশি সবাই খেয়েছি এবং এটাও জানি যে নাড়ু সব সময় মিষ্টিই হয়ে থাকে।
কিন্তু হাসনের দলার স্বাদটা একটু আলাদা কেননা এতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন রকমের মসলা। হাসনের দলা তৈরির মূল উপকরণ চাল ভাজার গুঁড়ো । চাল ভেজে গুঁড়ো করে তার সাথে গুড়, গোলমরিচের গুঁড়ো,এলাচ গুঁড়ো, দারচিনি গুঁড়ো, লবন, লবঙ্গ গুঁড়ো দিয়ে জ্বাল করে ছোট চোট গোল গোল করে নাড়ু বানানো হয়। কেউ আবার হাতের মুঠির সমান করে আকৃতি দেয় নাড়ুর। হাতের ভেতর দলা পাকিয়ে তৈরি করা হয় বলেই এই খাবারের নাম হয়েছে হাসনের দলা।
৬. জ্বাল দেয়া মাংস
কুমিল্লার খুবই প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী খাবার জ্বাল দেয়া মাংস। যখন ঘরে ঘরে এতো ফ্রিজ এর প্রচলন ছিল না তখন বড় পাতিলে হালকা তেল হলুদ ও মসলা দিয়ে জ্বাল দিয়ে রাখা হতো মাংস। প্রতিদিনই রান্নার শেষে একবার এই মাংস জ্বাল দেয়া হতো। সেই থেকেই কুমিল্লায় এই জ্বাল দেয়া মাংস খাওয়ার প্রচলন। জ্বাল দিতে দিতে মাংসের মধ্যে এক অন্যরকম স্বাদ চলে আসে। গরম ভাত বা পান্তা ভাতের সাথে এই জ্বাল দেয়া মাংস খাওয়ার স্বাদই অতুলনীয় ।
৭. মাড়ি পিঠা
কুমিল্লার খুবই জনপ্রিয় ও প্রচলিত একটি পিঠা ‘মাড়ি পিঠা’। মাড়ি পিঠা এক ধরনের ডেজার্ট আইটেম যা সাধারণত কাঁঠালের সাথে খাওয়া হয়। কাঁঠালের সিজনে কুমিল্লার ঘরে ঘরে মাড়ি পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পোলাওয়ের চাল ভিজিয়ে শীল পাটায় বেটে অথবা ব্লেন্ড করে তা দুধ, গুড়, নারকেল ও গরম মসলা দিয়ে রান্না করা হয় ।তবে পায়েসের মতো একদম পাতলা করা হয় না যাতে হাত দিয়ে খাওয়া যায়। রান্না করা সুস্বাদু এই পিঠা পাকা কাঠালের সাথে মেখে খেতে অসাধারণ।
৮. ডিম চিতই
চিতই পিঠা তো কমবেশি সবাই খেয়েছি বা পছন্দ করি। চিতই পিঠার এক নতুন সংস্করণ ডিম চিতই যা কিনা কুমিল্লায় বহুল প্রচলিত একটি খাবার। ডিম চিতই পিঠা তৈরিতে চালের গোলার উপড় আস্ত ডিম ভেঙে দেয়া হয় কড়াইয়ে। ভালোভাবে বানাতে পারলে সাধারণ চিতই পিঠাই ফুলে ফেপে বেশ নরম হয়ে ওঠে, তার মধ্যে দিম দিলে তো কোনো কথাই নেই। খেতে হয় একদমই রাজকীয় স্বাদের। ডিম চিতই পিঠা শুধু খেতেও ভালো লাগে। তবে ভর্তা ও মাংস দিয়ে সবথেকে বেশি ভালো লাগে ।
কুমিল্লা জেলার আরও কয়েকটি জনপ্রিয় খাবার হলো:
১. চুটকি সেমাই
২. করল্লা দিয়ে বুটের ডাল
৩. ডায়নার হালিম
৪. মাঈনুদ্দিন বেকারির পেটিস
৫. চুয়ার মৌ / কাঁচা ডেওয়ার টক
৬. গোমতি
৭. চিমটি পিঠা
৮. লাল ভর্তা (সিদল ভর্তা)
৯. মুইঠা ভাত (ইত্যাদি)

