খুলনার বিখ্যাত রূপসা সেতু (খান জাহান আলী সেতু) ও হাদিস পার্ক এ ভ্রমণ কাহিনি

আমি একজন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার এর ছাত্র। পড়ালেখা করছি খুলনা সিটি কলেজে।আমার স্কুল লাইফ কেটেছে সাতক্ষীরা তে। কলেজ লাইফে এসে এই নতুন শহরে বেশিদিন হয়নি এসেছি। তারপরও কিছু বন্ধু আমার হয়ে গিয়েছিল।তাদের সাথে কাটতো আমার সময়গুলো।মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পরে বিভিন্ন জায়গায় বসে আড্ডা দিতাম। 


একদিন আমার একজন অন্যতম কাছের বন্ধু আশিক বললো,চল বন্ধু আমরা একদিন হাদিস পার্কে যায় ঘুরতে।অনেকে তাকে সায় দিল।আমিও ভাবলাম যেহেতু এই শহরে তেমন ঘুরাঘুরি হয়নি তেমন বেশি কিছু চিনি না তাই যায় বন্ধুদের সাথে হাদিস পার্ক টা একটু ঘুরে আসি। নতুন অভিজ্ঞতার জন্য আমি বিচলিত ছিলাম। 


আমি বললাম ঠিক আছে বন্ধু তাহলে চল একদিন সবাই মিলে ঘুরে আসি গিয়ে।আমাদের কলেজে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের শুক্রবার দিন নির্ধারিত হলো।আমরা সেদিনের মতো উঠে পড়লাম।

নির্ধারিত শুক্রবার দিনে সকাল ১০ টাই আমরা ৫ বন্ধু মডার্ন মোড়ে মিলিত হলাম।আমরা সকালের নাস্তা বাসা থেকে করে এসেছিলাম যে যার মতো।আমরা নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করে তারপর ২ টি রিকশা নিয়ে চললাম হাদিস পার্কের উদ্দেশ্যে।আমি প্রথমবারের মতো সেখানে যাচ্ছি ভেবে খুবই উত্তেজিত ছিলাম। যায় হোক গল্প করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম হাদিস পার্কে।

পার্কটি এককথায় খুবই সুন্দর।ভেতরে জায়গাটি ছোট কিন্তু খুবই সুন্দরভাবে ডিজাইন করা এই পার্কটি যে কারো নজর আটকে রাখার জন্য যথেষ্ট।পার্কটির মূল ফটকের সামনে ও পাশে বেশ কিছু দোকান রয়েছে।
এসব দোকানে ফুচকা,রোল,পুরি, বেভারেজ আইটেম,চা,বিস্কুট এইসব খাবার বিক্রয় করা হয়।অর্থাৎ ফাস্টফুড ও জাঙ্কফুড এর জন্য দোকান গুলো দেওয়া হয়েছে।এছাড়াও অন্য পাশে হালিম,চটপটি ,বিরিয়ানি, চিকেন আইটেম ইত্যাদি সকল ধরণের খাবারই এখানে পাওয়া যাবে।

পার্কটির মূল ফটকের দরজাটি খুবই বড় এবং সুন্দর কাজ করা। এই ফটকটির বৈশিষ্ট হচ্ছে এখানে ৩ টি প্রবেশদ্বার রয়েছে পাশাপাশি লাগানো।এর মধ্যে মাঝেরটি হলো সবচেয়ে বড় আর এর ২ দিকে ২ টি ছোট ছোট দরজা রয়েছে।মূলত সাধারণ সময়ে ওই ২ টি দরজার মধ্যে ১ টি দিয়ে মানুষ প্রবেশ করে এবং আরেকটি দিয়ে মানুষের বাইরে বের হয়ে যায়।

পার্কটির ভেতরে প্রবেশ করলাম। ঢুকেই দেখলাম ওজন আর উচ্চতা মাপার যন্ত্র নিয়ে প্রধান দরজার সামনের অংশটা দখল করে রেখেছে কিছু মানুষ। অনেকদিন হলো আমার ওজন মাপি না। বাকিদের বললাম আমার সাথে তোরাও ওজন আর উচ্চতা মেপে নিতে পারিস।


 তারাও রাজি হলো। ৫ টাকা দিয়ে ওজন আর ৫ টাকা দিয়ে উচ্চতা মেপে নিলাম এক এক করে সবাই। আমার ওজন টা আগের চেয়ে একটু বেড়েছে। যায় হোক ওজন-উচ্চতা মাপা হয়ে গেলে সামনে এগোলাম। সামনেই পার্কের মধ্যেই দেখতে পেলাম একটি খুবই সুন্দর লেক। লেক টার আয়তন বেশ বড়। খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি লেক। 


সামনে এগোনোর ২ টি পথ আছে এখানে। লেকের ডান দিক এবং বাম দিক দিয়ে ২ টি পথ চলে গেছে। আমরা ডান দিকের পথটি বেছে নিলাম। হাঁটা শুরু করলাম ওই পথ ধরে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম তা হলো লেকের ২ দিকের পথগুলোতে বসে রেস্ট নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বসার জায়গা রয়েছে। আর ডান দিকের রাস্তার শুরুতেই নতুন করে পাবলিক টয়লেটে নির্মাণ করা হয়েছে। 


অবশ্য নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য পরিশোধ করে পাবলিক টয়লেট ব্যাবহার করতে হবে। সেখানে ১০ টাকা দিয়ে পায়খানা আর ৫ টাকা দিয়ে প্রস্রাবের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে কারোরই এই পাবলিক টয়লেট ব্যাবহার করার প্রয়োজন হয়নি।

যায় হোক আমরা সরু রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। সকালে গিয়েছিলাম এইজন্য পার্কে তেমন লোকজন ছিল না। আমরা কিছু সেলফি তুললাম। তারপর লেকের চারদিকে ঘুরলাম।খেয়াল করলাম লেকের পানিতে অনেকগুলো মাছ ছাড়া আছে। জানতে পারলাম সিজন আসলে এখানে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা এর আয়োজন করা হয়। 


লেকের বাম দিকে এসে দেখি এখানে সুন্দর একটি বাগান রয়েছে।অনেক্ষন আমরা ভেতরে ঘুরলাম। পার্কের ভেতরে খুব সুন্দর পরিবেশ । ফ্যামিলি সহ আসা যাবে। দুপুর হয়ে গিয়েছে। তাই আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে দুপুরের লাঞ্চ করলাম। আমাদের বন্ধু শাহেদ আমাদেরকে লাঞ্চ করলো।

বিকাল হয়ে গিয়েছিল। আমরা আছরের নামাজ পড়ে রূপসা সেতুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটা ইজিবাইক ভাড়া করেছিলাম। এখন থেকে রূপসা সেতুতে ইজিবাইক যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লেগেছিল। রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে সেতু পর্যন্ত রাস্তাটির অবস্থা খুবই বাজে। আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে আমরা অবশেষে সেতুতে পৌঁছে গেলাম।

তখন যেহেতু বিকাল ছিল আবার ছুটির দিন ছিল অসংখ্য মানুষের ভিড় ছিল সেতুর উপরে এবং নিচে। সেতুর এপাশে এবং ঐপাশে ২ টি করে মত ৪ টি সিঁড়ি আছে। প্রতি পাশে ২ টি করে। সেতুর নিচে ফুচকা,চটপটি,বিরিয়ানি, ছোলা এইসব এর দোকান ছিল অনেক। আমরা লোভ সামলে না পেরে একটু খেয়ে নিলাম। নদীতে ঘুরার জন্য নৌকার ব্যবস্থাও রয়েছে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে সেতুতে উঠে পড়লাম।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। তার আগে বলে রাখি এই রূপসা সেতুকে বলা হয় খুলনার প্রবেশদ্বার। এটির নাম মূলত খান জাহান আলী সেতু।সেতুটি রূপসা নদীর উপরে অবস্থিত হওয়ার কারণে এটি রূপসা সেতু নামেও পরিচিত। সেতুর এই পাশ চলে গেছে খুলনার বাইপাস হয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। 


আর অপর পাশ দিয়ে গোপালগঞ্জ,বাগেরহাট,ঢাকা অর্থাৎ যেকোনো জেলায় যাওয়া যাবে। সেতুতে মূলত ২ টি বড়ো লেন এবং প্রতি সাইডে ১ টি করে ছোট লেন রয়েছে।এখানে ছোট ছোট যানবাহন যেমন সাইকেল,মোটর বাইক এগুলো যাতায়াত করতে পারবে। আর মানুষের চলাচলের জন্য ছোট রোডের পাশে আবার উভয় সাইডে ফুটপাথ রয়েছে।এখানে মানুষ দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারে এবং সেতু পার হতে পারে। সেতুর অপর দিকে একটি টোলপ্লাজা রয়েছে। সেই জায়গাটাও বেশ বড় ও সুন্দর।

আমরা সেতুতে উঠে একটু হেটে সামনের দিকে গেলাম। ছোট বড় গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।দেখলাম যে আমাদের হাটার রাস্তায় কিছু মটরসাইকেলও আসছে। কারণ আসল পথ থেকে ছোট গাড়ি চললে দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। কিছু দূর এগোতেই দেখলাম, কয়েকটি ছেলে কিছু খাবারের জিনিস বিক্রি করছে।সেতুর মাঝখানে যেতেই চোখে পড়লো, বহুকালের পুরাতন রূপসা সেতু। এটি দেখার পর যে কারোর মন ভালো হয়ে যাবে। 


অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আমাদের সবাইকে আকৃষ্ট করলো। নদী এবং তার ওপর বয়ে চলেছে অসংখ্য জাহাজ , নৌকা,স্পীডবোট। আমরা আর দেরি না করে এক একজন করে সবাই যার যার মতো ছবি তুলে নিলাম। কেও ছবি তুলছে নদীর সাথে আর কেউবা তুলছে সেতুর সাথে।এইরকম পরিবেশে সবারই ইচ্ছা হয় ছবি তোলার। ছবি তোলার পর আমরা ধীরে ধীরে সামনে এগোতে লাগলাম। সেতুর শেষ দিকে গিয়ে দেখলাম একটি টোল। 


টোল এ বহু গাড়ি রয়েছে। গাড়িগুলো সেতু পার হওয়া বা সেতু তে ওঠার জন্য সেখানে টাকা দিচ্ছে। পাশেই তাকাতে দেখলাম একটি রেস্টুরেন্ট। সেখানে অনেক মানুষ তাদের প্রিয় মানুষদের নিয়ে এসেছে। আবার কেউ তাদের পরিবারের সাথে এসেছে। এখানে প্রতিদিনই অনেক মানুষ খাবার খেতে হাজির হয়। এরপর আমরা সবাই আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম।সেতু থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম অদূরেই একটি রেলসেতু নির্মাণের কাজ চলছে। এই রেলসেতুটি ঢাকার সাথে মংলার সংযোগ স্থাপন করেছে।

সেতুর অপর পাশেও ২ টি ব্রিজ আছে।কিন্তু আমরা না নেমে আমরা এইদিকে চলে আসলাম। এদিকের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলাম।আস্তে আস্তে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে। সন্ধ্যার দিকে আকাশের লাল আভা নদীর উপর পড়ছিল।সেই দৃশ্য এখন চোখে লেগে আছে।যায় হোক আমরা আর বেশিক্ষন অপেক্ষা করলাম না। ইজিবাইক নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

Scroll to Top