বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময় অনেক যাত্রী জানতে চান—কোন জিনিস শুল্কমুক্তভাবে আনা যায়, কত পরিমাণ আনা যায় এবং কাস্টমসে কীভাবে ঘোষণা দিতে হয়। এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে জানা দরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) কর্তৃক নির্ধারিত Baggage Rules, যা বাংলাদেশে শুল্কমুক্ত আমদানির প্রধান নির্দেশিকা।
শুল্কমুক্ত বা ডিউটি-ফ্রি পণ্য কী
শুল্কমুক্ত বা Duty-Free পণ্য হলো এমন জিনিস যা আপনি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আনতে পারেন, এবং এর জন্য কোনো কাস্টমস শুল্ক বা ভ্যাট দিতে হয় না। তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বড় পরিমাণে পণ্য আনলে এই সুবিধা প্রযোজ্য হয় না।
এই নিয়মের আওতায় বাংলাদেশি প্রবাসী, বিদেশফেরত যাত্রী এবং বিদেশি নাগরিকরা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পণ্য আনতে পারেন।
কত পরিমাণ পণ্য শুল্কমুক্তভাবে আনা যায়
NBR অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক যাত্রী (বয়স ১২ বছর বা তার বেশি) সর্বোচ্চ ৬৫ কেজি ওজনের ব্যক্তিগত পণ্য আনতে পারেন।
১২ বছরের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে এই সীমা ৪০ কেজি।
শুল্কমুক্তভাবে আনা যায় এমন জনপ্রিয় পণ্য
বিদেশ থেকে ফেরার সময় নিচের পণ্যগুলো সাধারণত শুল্কমুক্তভাবে আনা যায়—
- একটি ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার ও স্ক্যানার
- একটি ভিডিও ক্যামেরা বা ডিজিটাল ক্যামেরা (অ-বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য)
- একটি রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, টোস্টার, ব্লেন্ডার, কফি মেকার বা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি
- একটি সেলাই মেশিন বা হেয়ার ড্রায়ার / ট্রিমার
- একটি ব্যবহৃত মোবাইল ফোন এবং একটি নতুন মোবাইল ফোন
- সোনার অলঙ্কার সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম এবং রূপার অলঙ্কার ২০০ গ্রাম পর্যন্ত
- একটি কার্পেট বা গালিচা (সর্বোচ্চ ১৫ বর্গমিটার পর্যন্ত)
- বই, পোশাক, জুতা, পারফিউম, প্রসাধনী, টয়লেট্রিজ ও শিশুদের খেলনা
- উপহার সামগ্রী যার মোট মূল্য সর্বোচ্চ ৮০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত (যদি যাত্রী বিদেশে অন্তত ৭ দিন অবস্থান করেন)

১. ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার ও স্ক্যানার
যাত্রীরা একটি ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার, সাথে একটি প্রিন্টার ও স্ক্যানার শুল্কমুক্তভাবে আনতে পারেন।
এই নিয়ম মূলত শিক্ষার্থী, প্রবাসী কর্মী ও সাধারণ যাত্রীদের সুবিধার জন্য করা হয়েছে। তবে একাধিক কম্পিউটার বা প্রিন্টার আনলে সেটি বাণিজ্যিক হিসেবে গণ্য হবে এবং শুল্ক দিতে হবে।
২. ভিডিও ক্যামেরা বা ডিজিটাল ক্যামেরা
একটি ভিডিও ক্যামেরা বা ডিজিটাল ক্যামেরা আনা যায় শুল্কমুক্তভাবে, যদি তা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য হয়।
যদি পেশাদার মানের ক্যামেরা বা বড় লেন্সসহ DSLR আনেন, কাস্টমস সেটিকে বাণিজ্যিক ব্যবহার ধরে নিতে পারে এবং শুল্ক প্রযোজ্য হতে পারে। সাধারণ পরিবারের ছবি তোলা, ভ্রমণ বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ক্যামেরা আনলে কর দিতে হয় না।
৩. রান্নাঘরের ইলেকট্রনিক যন্ত্র
যাত্রীরা সাধারণ গৃহস্থালি ব্যবহারের যন্ত্র যেমন—রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, টোস্টার, ব্লেন্ডার, কফি মেকার, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি বা মাইক্রোওভেন — প্রতিটি একটির বেশি না আনলে শুল্কমুক্তভাবে আনা যায়।
এই পণ্যগুলো দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়, তাই সরকার এগুলোকে ব্যক্তিগত ব্যবহার হিসেবে বিবেচনা করে করমুক্ত সুবিধা দিয়েছে।
৪. সেলাই মেশিন, হেয়ার ড্রায়ার বা ট্রিমার
একটি সাধারণ সেলাই মেশিন বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের হেয়ার ড্রায়ার, ট্রিমার বা শেভার আনতে কোনো শুল্ক দিতে হয় না।
তবে একাধিক বা শিল্পোৎপাদন উপযোগী সেলাই মেশিন আনলে সেটি বাণিজ্যিক হিসেবে গণ্য হবে।
৫. মোবাইল ফোন
প্রত্যেক যাত্রী একটি ব্যবহৃত মোবাইল ফোন (যা তার নিজস্ব ব্যবহারের) এবং একটি নতুন মোবাইল ফোন আনতে পারেন শুল্কমুক্তভাবে।
তৃতীয় কোনো ফোন আনলে সেটির ওপর নির্ধারিত শুল্ক ও ভ্যাট প্রযোজ্য হবে।
এই নিয়মটি ২০২৩ সালে NBR আপডেট করেছে, যাতে যাত্রীরা সহজে একটি নতুন ফোন আনতে পারেন কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির সুযোগ না থাকে।
৬. সোনা ও রূপার অলঙ্কার
একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম সোনার অলঙ্কার এবং ২০০ গ্রাম রূপার অলঙ্কার শুল্কমুক্তভাবে আনতে পারেন।
তবে সোনা বা রূপা বারে আনা যাবে না — শুধুমাত্র অলঙ্কার আকারে হতে হবে।
যদি এর বেশি পরিমাণ আনেন, তবে নির্ধারিত হারে শুল্ক ও কর দিতে হবে এবং ঘোষণা না দিলে তা জব্দও হতে পারে।
৭. কার্পেট বা গালিচা
একটি কার্পেট বা গালিচা (সর্বোচ্চ ১৫ বর্গমিটার পর্যন্ত) শুল্কমুক্তভাবে আনা যায়।
এটি সাধারণত প্রবাসীদের গৃহস্থালি ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত, তবে একাধিক বা বড় আকারের গালিচা আনলে তা বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ধরা হবে।
৮. ব্যক্তিগত পোশাক, জুতা ও আনুষঙ্গিক পণ্য
যাত্রীরা নিজের ব্যবহারের জন্য যত কাপড়, জুতা, ব্যাগ, পারফিউম, প্রসাধনী বা টয়লেট্রিজ আনতে চান আনতে পারেন, যদি তা সীমিত পরিমাণে হয় এবং বিক্রির উদ্দেশ্যে না হয়।
যেমন—২-৩ জোড়া জুতা, কয়েক সেট পোশাক, কিছু কসমেটিক বা সুগন্ধি। অতিরিক্ত পরিমাণ আনলে কাস্টমস সেটিকে বাণিজ্যিক হিসেবে দেখতে পারে।
৯. বই, উপহার সামগ্রী ও খেলনা
বই, নোটবুক, খেলনা, ও ব্যক্তিগত উপহার সামগ্রী শুল্কমুক্তভাবে আনা যায়।
তবে উপহার সামগ্রীর মোট মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করা যাবে না (যদি আপনি বিদেশে অন্তত ৭ দিন অবস্থান করেন)।
এর বেশি মূল্যের উপহার আনলে নির্ধারিত হারে শুল্ক দিতে হবে।
যেসব পণ্যে শুল্ক দিতে হয়
নিম্নলিখিত পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর প্রযোজ্য:
- অতিরিক্ত টিভি, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার, বা হোম থিয়েটার
- বাণিজ্যিক পরিমাণে আনা ইলেকট্রনিক সামগ্রী বা পোশাক
- সোনা, হীরা বা বৈদেশিক মুদ্রা নির্ধারিত সীমার বেশি আনলে
- বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীর জন্য এলকোহল বা মদ নিষিদ্ধ
- মূল্যবান গয়না, ঘড়ি বা বিলাসবহুল উপহার সামগ্রী অতিরিক্ত আনলে
বৈদেশিক মুদ্রা বহনের সীমা
যাত্রীরা সর্বোচ্চ ১০,০০০ মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্গে আনতে পারেন।
বাংলাদেশি মুদ্রা সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত বহন করা যায়।
এর বেশি মুদ্রা আনলে বিমানবন্দরে কাস্টমসে তা ঘোষণা করতে হয়।
কাস্টমস প্রক্রিয়া ও ঘোষণা পদ্ধতি
বিমানবন্দরে নামার পর দুটি কাস্টমস পথ থাকে—
- Green Channel: যদি আপনার সব পণ্য শুল্কমুক্ত সীমার মধ্যে থাকে।
- Red Channel: যদি কোনো শুল্কযোগ্য বা অতিরিক্ত পণ্য থাকে।
যদি Red Channel বেছে নিতে হয়, তাহলে আপনাকে পণ্য ঘোষণা করতে হবে।
কাস্টমস অফিসার পণ্য যাচাই করে নির্ধারিত শুল্ক নির্ধারণ করবেন। এরপর আপনি ব্যাংক কাউন্টারে শুল্ক পরিশোধ করে রসিদ সংগ্রহ করবেন।
এয়ারপোর্টে পন্য আনায় গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা
- শুল্কমুক্ত সুবিধা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য প্রযোজ্য।
- একই ধরনের পণ্য একাধিক আনলে তা বাণিজ্যিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
- বিদেশে অবস্থানের সময় যদি ৭ দিনের কম হয়, তাহলে উপহার সীমা কমে যায়।
- নিয়ম লঙ্ঘন করলে পণ্য আটকানো বা জরিমানা হতে পারে।
উপসংহার
বাংলাদেশে বিদেশফেরত যাত্রীদের জন্য শুল্কমুক্ত পণ্য আনার সুযোগ অনেক সহজ, তবে সঠিক নিয়ম জানা অত্যন্ত জরুরি।
আপনি যদি নিয়ম মেনে পণ্য আনেন, তাহলে কাস্টমস প্রক্রিয়া ঝামেলামুক্ত হয় এবং বাড়তি খরচও এড়ানো যায়।
ভ্রমণের আগে একবার NBR-এর অফিসিয়াল Baggage Rules পড়ে নেওয়া এবং সন্দেহ হলে কাস্টমস অফিসার বা অনুমোদিত কনসালটেন্টের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত।

